পানি কীভাবে দূষিত হয় আমরা মোটামুটিভাবে সেটা জেনেছি। পানিদূষণ প্রতিরোধ করতে হলে দূষণের কারণগুলো জেনে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাটাই হবে দূষণ প্রতিরোধের বড় কৌশল। পানিদূষণ প্রতিরোধে কী কী কৌশল অবলম্বন করা যায়, সেগুলো একটু দেখে নিই।
জলাভূমি: আজকাল আমাদের দেশে জলাভূমি ভরাট করে ঘর-বাড়ি, আবাসন এলাকা, শপিং মল ইত্যাদি তৈরি করা শুরু হয়েছে। তোমরা কি জান যে নিচু জলাভূমি পানি ধারণ করা ছাড়াও যে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে? জলাভূমি একদিকে পানি ধারণ করে যেমন বন্যা নিয়ঋণ করে, অন্যদিকে তেমি ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে, ভূগর্ভে এবং নদীতে বিশুদ্ধ পানি সঞ্চালন করে এবং বন্যপ্রাণীদের সাহায্য করে। বনভূমিও কিন্তু ভূগর্ভে পানি সঞ্চালনে সাহায্য করে এবং একই সাথে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। এগুলো ধ্বংস হলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর দূষণ বেড়ে যায়। জলাভূমি, বনভূমি রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হলে পানির দূষণ অনেক খানি কমে যাবে। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখন আমাদের দেশেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বৃক্ষরোপণ করে, জলাভূমি, হ্রদ ও সমুদ্রের তীরে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে পানির দূষণ রোধে জনসচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছে- সেটি অনেক আশার কথা ।
বৃষ্টির পানি নিয়ন্ত্রণ
শহরাঞ্চলে পানিদূষণের একটি বড় কারণ বৃষ্টির পানির প্রবাহ। তোমরা জান, শহরাঞ্চলের রাস্তাঘাটসহ বেশিরভাগ এলাকা পাকা হওয়ায় বৃষ্টির পানি এখন এর ভেতর দিয়ে ভূগর্ভে যেতে পারে না। ফলে বৃষ্টির পানি যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা আর অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে নর্দমা আর নালা দিয়ে নদী, জলাশয় বা হ্রদে গিয়ে সেখানকার পানিকে দূষিত করে। কীভাবে এটি বন্ধ করা যায় বাসার ছাদে বৃষ্টির পানি কি সংগ্রহ করা সম্ভব? অবশ্যই এটি সম্ভব এবং খুব সহজেই তা করা যায়। এভাবে সংগ্রহ করা পানি আমরা বাগান বা ফুলের টবে ব্যবহার করতে পারি, এমনকি কাপড়-চোপড় ধোয়া বা পায়খানায় শৌচ কাজেও ব্যবহার করতে পারি। এতে একদিকে যেমন পানির দূষণ বন্ধ হবে, অন্যদিকে তেমনি পানি সরবরাহের উপর চাপও কম পড়বে। তোমরা অনেকেই জান যে ঢাকা শহরে গ্রীষ্মকালে অনেক এলাকাতে পানির প্রচণ্ড অভাব থাকে। এমনও দেখা গেছে যে কোনো কোনো এলাকায় ৩-৪ দিন একটানা কোনো পানি পাওয়া যায় না। এরকম অবস্থায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করলে পুরো পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সেটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে সরকার, সিটি কর্পোরেশন অথবা নাগরিক সমাজ সবাই নিজেদের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাসা-বাড়ি ছাড়া অন্যান্য জায়গায় বৃষ্টির পানির দূষণ কীভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে? আমরা কংক্রিটের বদলে কোনো ধরনের ছিদ্রযুক্ত পদার্থ ব্যবহার করতে পারি, যার ভিতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে জমা হতে পারে। গ্রাভেল (Gravel) এরকম একটি পদার্থ, যা কংক্রিটের বদলে ব্যবহার করা যায়। আবার সম্ভব হলে বড় গর্ত বা খাল তৈরি করে সেখানেও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা যায়। পৃথিবীর অনেক বড় শহরেই এ রকম ব্যবস্থা আছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি
তোমরা কি বুঝতে পারছ যে শহরাঞ্চলে পানিদূষণকারী ক্ষতিকর বর্জ্যগুলোর বড় একটি অংশ আসে আমাদের বাসা-বাড়ি থেকে? আমরা অ্যারোসল, পেইন্টস, পরিষ্কারক, কীটনাশক নানারকম ক্ষতিকারক পদার্থ অহরহ ব্যবহার করি এবং ব্যবহারের পর অবিবেচকের মতো খালি কৌটা যেখানে-সেখানে ফেলে দিই বা রেখে দিই, যেগুলো একপর্যায়ে এসে পানি দূষণ করে। এগুলো এভাবে না ফেলে আমরা যদি যথাযথভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলি, তাহলেও কিন্তু পানিদূষণ অনেক কমে যাবে। এসব পদ্ধতিতে দূষণ কমানোর জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য রেডিও-টেলিভিশনে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আর সতর্কবার্তা প্রচার করা যেতে পারে। এমনকি তোমরা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা পানির প্রয়োজনীয়তা, অপ্রতুলতা এবং দূষণ প্রতিরোধ বিষয়ে পোস্টার তৈরি করে মানুষকে সচেতন করতে পার। ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
শিল্প-কারখানার দ্বারা পানির দূষণ প্রতিরোধ
শিল্প-কারখানার সৃষ্ট বর্জ্যপানি নদীর পানিদূষণের প্রধান একটি কারণ। এই দূষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, সৃষ্ট বর্জ্যপানি পরিশোধন করে তারপর নদীতে ফেলা। এ পরিশোধন কাজের জন্য দরকার বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা (Effluent Treatment Plant : ETP) বা ইটিপি। ইটিপি কীভাবে তৈরি করা হবে, সেটা নির্ভর করে বর্জ্যপানিতে কী ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ আছে তার ওপর। যেহেতু একেক ধরনের শিল্প-কারখানা থেকে একেক ধরনের বর্জ্যপানি বের হয়, তাই একটি সাধারণ ইটিপি দিয়ে সব কারখানার বর্জ্যপানি পরিশোধন করা সম্ভব নয়। তবে একই ধরনের শিল্প-কারখানা দিয়ে
একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলে সব কারখানার বর্জ্যপানি একত্র করে একটি বড় ইটিপিতে পরিশোধন করা যেতে পারে। কৃষিজমি থেকে মাটির ক্ষয়জনিত দূষণ প্রতিরোধ একটি জমিতে বছরের পর বছর ফসল চাষ করলে ধীরে ধীরে তার উর্বরতা নষ্ট হয়, আর উর্বরতা নষ্ট হলে মাটির ক্ষয় অনেক বেড়ে যায়। আমরা যদি জৈব সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বাড়াই, তাহলে সেটি মাটির ক্ষয়রোধ করতে সাহায্য করে। তোমরা কি বলতে পার এটি কীভাবে সম্ভব? মাটিতে জৈব সার থেকে আসা জৈব পদার্থ বেশি থাকে বলে সেটি বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে, বৃষ্টি হলে খুব সহজেই সেটি প্রবাহিত হয়ে যায় না বা মাটির কণা সহজে বাতাসে উড়ে গিয়ে নদীর পানি দূষিত করে না। এতে করে মাটির কণা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ যেমন: কীটনাশক, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের যৌগ ইত্যাদি দ্বারা দূষণও কমে যায়। আবাদি জমির চারপাশে পুকুর খনন করেও পানির দূষণ প্রতিরোধ করা যায়। তোমরা কি জান ক্ষেত থেকে ফসল কাটার পর ফসলের যে অবশিষ্ট অংশ জমিতে থেকে যায়, সেগুলো পানির দূষণ রোধ করে? ফসলের ধরন পরিবর্তন করেও পানিদূষণ রোধ করা যায়। যখন-তখন সার প্রয়োগ না করে ঠিক সময়ে বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের আগ মুহূর্তে সার প্রয়োগ না করে দূষণ প্রতিরোধ করা যায়।
উন্নয়ন কার্যক্রমে পানির ভূমিকা
আমাদের দেশ এখনো কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। আর সেই কৃষিকাজে সেচের জন্য দরকার পানি অর্থাৎ পানি ছাড়া কোনোভাবেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঘর-বাড়ি কি পানি ছাড়া তৈরি হয়? না, অসম্ভব। আবার উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশ শিল্পে অত্যন্ত উন্নত, এমন কোনো শিল্প কারখানা কি আছে, যেখানে পানির প্রয়োজন নেই? না, নেই। সকল শিল্প-কারখানায় কোনো না কোনো পর্যায়ে পানি ব্যবহার করতেই হয়। তাহলে আমরা বলতে পারি, উন্নয়ন এবং পানি একে অপরের পরিপূরক।
আরও দেখুন...